গ্রুপভিত্তিক মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম বাইপ্রোডাক্টের গুরুত্ব
গ্রামীন ব্যাংকের মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালু হয় মহিলাদের গ্রুপভিত্তিক ঋণদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কোলাটেরাল বা জামানতবিহীন এই ঋণে একের দায়ে গ্রুপের অন্য সদস্যদেরও অলিখিতভাবে একাউন্টেবল করা হয়। যাদেরকে প্রচলিত পদ্ধতি ঋণ পাবার অযোগ্য মনে করেছিলে, কালের পরিক্রমায় তারাই হয়ে ওঠে এদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঋণী (Debtor)। এদেশে ব্যাংকব্যবস্থাপনায় যেখানে খেলাপী ঋণের পরিমান প্রায় এক তৃতীয়াংশ, জামানতবিহীন এসকল ঋণী’র কাছ থেকে ঋণ ফেরতের হার পঁচানব্বই শতাংশ’র বেশী। গ্রামীন ব্যাংকের গ্রুপভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনার এ মডেল দ্রুতই ব্র্যাক, আশা সহ আরো সহস্রাধিক এনজিও’কে আকৃষ্ট করে। ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহরের আনাচে-কানাচে। গ্রামীন ব্যাংক ও তার প্রতিষ্ঠাতা ড: মুহম্মদ ইউনুসকে এনে দেয় নোবেল শান্তি পুরষ্কার।
ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচীর এই আখ্যানে প্রচলিত ঋণ ও সঞ্চয় কার্যক্রমের গল্পটি নতুন না। এবং এই লেখার উদ্দেশ্যও ঋণ প্রাপ্তি বা কিস্তি প্রদানের তথ্যে নিহিত নয়।
গ্রুপমিটিং – সমিতি বা গ্রুপভিত্তিক মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রামের অন্যতম অংশ:
গ্রামীন ব্যাংকের আদলে এদেশে কোলেটরাল বা জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের যে বিপ্লব ঘটেছিলো তা ছিলো মূলত: গ্রুপলেন্ডিং বা সমিতিভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে এখানে পাঁচজন সদস্য’কে নির্বাচিত করে একটা গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল, যাদের ঋণফেরতের ধরনের উপর ভিত্তি করে সদস্য বৃদ্ধি-হ্রাস সহ ঋণের পরবর্তী দফার পরিমানও নির্ভর করতো। উল্লেখ্য যে, গ্রুপভিত্তিক এই ঋণ কার্যক্রমের মূল বেনেফিশায়ারি হলো নারী।
একজন প্রশিক্ষিত ঋণকর্মী (Credit Officer) বা মাঠকর্মী (Field Officer) সাপ্তাহিক সমিতি মিটিং-এ ঋণের কিস্তি, সঞ্চয়ের কিস্তি আদায়, প্রাপ্ত ঋণের ব্যবহার, ঋণলব্ধ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা, ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শ ছাড়াও আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁর এই আলোচ্যসূচীর মধ্যে স্থান পায় সামাজিক দায়বদ্ধতা, পারিবারিক বিভিন্ন পরামর্শ, মাতৃমঙ্গল, মহিলা ও শিশুসহ সাধারন স্বাস্থ্যগত পরামর্শ। গ্রাম ও শহরের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জনপদ ক্ষুদ্রঋন কর্মসূচীর প্রধানতম উপকারভোগী। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মহিলারা তাঁদের পরিবারে পুরুষদের অধিনস্ত – নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে এই চিত্রটি আরো বেশী সত্য। অশিক্ষা বা কুশিক্ষার প্রভাবে সাধারণ দরিদ্র পরিবারে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষা বা জ্ঞানের প্রবাহ অপ্রতুল।
এমনতর পরিস্থিতিতে একজন প্রশিক্ষিত মাঠকর্মীর বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত পরামর্শ গ্রুপের সদস্যদের জন্য অনেকক্ষেত্রেই দারুন উপকার বয়ে আনে। একজন অভিজ্ঞ মাঠকর্মী শুধু স্বাস্থ্যগত পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হোন না, উনি সদস্যদেরকে তার ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা, পরিষেবা প্রাপ্তি’র স্থান-কাল-খরচ সহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়েই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। দরিদ্র এই নারীকূল, যারা শিশুকাল থেকে পারিবারিক ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার, সামাজিকভাবে তুলনামূলক বিচ্ছিন্ন (Social Exclusion), শিক্ষার আলো যাকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারে নাই, তাঁদের জন্য এই নিবেদিত পরামর্শ অনেকক্ষেত্রেই ‘জীবন রক্ষাকারী’ (Life Saving) হিসাবে পরিগণিত হয়। এখানে গ্রুপের অন্যান্য অভিজ্ঞ ও পুরাতন সদস্যাদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য – তাঁরা তাঁদের বয়সজনিত অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারিক জ্ঞান সাপ্তাহিক গ্রুপ মিটিংগুলিতে আলোচনা করে থাকেন, যার সুফল পান বয়সে নবীন ও অনভিজ্ঞ সদস্যরা।
বাইপ্রোডাক্ট:
আমরা সবাই জানি যে, ক্রুডওয়েল রিফাইন করে পাওয়া যায় পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ও জেটফুয়েল যা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু, এটা কতজন জানেন যে, দুনিয়ার প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি’র কাঁচামালও কিন্তু পেট্রোলিয়াম শিল্প থেকেই আসে। প্লাষ্টিক ছাড়াও রাবার, টায়ার, সিনথ্যাটিক ফাইবার ইত্যাদির উৎস কিন্তু ক্রুডওয়েল বা পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি।
আমরা আজ ক্ষুদ্রঋণের ‘বাইপ্রোডাক্ট’র গল্প করবো, যেখানে ঋন সুবিধা ছাড়াও এমনকতগুলি বাইপ্রোডাক্ট ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হচ্ছে যা আমাদের মতো জনবহুল দরিদ্র দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে।
আসিয়া আক্তারের গল্প:
শিবগঞ্চের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে আসিয়া আক্তার। দিনমজুর বাবার পাঁচ (৫) সন্তানের মধ্যে আসিয়া আক্তারের সিরিয়াল হলো চার (৪)। একমাত্র ভাই আসগর আলীর সিরিয়াল হলো পাঁচ (৫)। বুঝতেই পারছেন কি ‘কদরে’ (!) আসিয়া আক্তার বাবা-মা’র সংসারে বড় হয়েছেন!
কোনরকমে ‘বড়’ হয়েছে আসিয়া – ঋতুচক্রের আগমনে আসিয়া’কে স্বামী’র বাড়িতে স্থানান্তরে একরকম হন্যে হয়েই বাবা-মা দিনাতিপাত করেছেন। তাই, দরিদ্য রিকশাওয়ালা মজনু মিয়া’র ঘরে এসে পেটের টানাপোড়ন না মিটলেও মানসিক দৈন্যতার হাহাকার যেনো আনুপাতিক হারে অনেকটাই কমে গিয়েছিলো। বিয়ের বছর যেতে না যেতেই আসিয়া হয়ে পড়েন ‘প্রেগনেন্ট’ – কিশোরী আসিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই সংসার জিবনের জটিল ও কঠিন জোয়াল নিতে একরকম বাধ্য হন। অনাগত সন্তানের প্রত্যাশায় যুবক মজনু মিয়া আনন্দে দিনাতিপাত করতে থাকেন। স্বামীর খুশী দেখে, আসিয়াও খুশী। অপুষ্ট আসিয়া বস্তিতে থাকলেও, বস্তি’র আর দশটা পরিবারের সাথে এখনো অতটা ‘ফ্রি’ হতে পারে নাই।
বিয়ের পরের প্রথম দিনগুলি’র মতো গতর খাটিয়ে কাজের অভ্যাস, প্রেগনেন্সি’র চার মাসেও চলমান রয়েছে। শরীরের ভেতর যে আরেকটি শরীর বেড়ে উঠছে, তার দিকেও যে খেয়াল করতে হবে, দু’মুঠো অন্ন যে আসিয়া’কে বেশী পেতেই হবে – কথাগুলি কে বলবে? এর ওর সাথে পরামর্শেরও তো কোনো সুযোগ আসিয়া পাচ্ছে না। আচ্ছা আসিয়া’র মা কি জানে এসব ব্যাপারগুলি – বলতে পারতো? কি জানি – আসিয়া তো বিয়ের পরে বাবা-মা’র কাছে একবারও ফেরত যায়নি। মজনু মিয়া’র সংসারে অভাব থাকলেও, মানুষ হিসাবে মজনু মিয়া ওতো খারাপ না – তাকে একরকম যত্ন-আত্তি’র মাঝেই রেখেছে, তাঁর সামর্থের মধ্যে। আসিয়া বুঝতেই পারলো না, পেটের অনাগত জীবন কখন যে ‘মিসক্যারেজ’ হয়ে গেলো!!!
সতেরো বছরের কিশোরী আসিয়া আক্তার পরবর্তীতে স্বামী’র পরামর্শে ও পেশার প্রয়োজনে নিলুফা আপার সাথে সাক্ষাৎ করে। নিলুফা স্থানীয় এক এনজিও কর্মী, সৎ-আন্তরিক-অভিজ্ঞ। আসিয়া আক্তারের প্রয়োজন ১টা ভ্যান কিনার অর্থ, যা তার স্বামী নিজেই চালাবে। আসিয়া’কে ভর্তি করে নেয়, সদস্য হিসাবে। অল্প অল্প সঞ্চয় জমা করে, একসময় ঋন পরিচালনা’র উপযুক্ত মনে করে এনজিও সংস্থাটি। ঋণ নিয়ে সংসারে কিছুটা আয় বৃদ্ধি’র আশায় স্বামী–স্ত্রী দেখতে থাকে সুখস্বপন। অবশেষে, এনজিও’র টাকায় আসিয়া ভ্যান কিনে দেন স্বামীকে। অন্যের রিকশা টানা বাদ দিয়ে, মজনু শুরু করেন নিজের ভ্যান চালানো।
ওদিকে সাপ্তাহিক কেন্দ্র মিটিং–এ আসিয়া’র সাথে পরিচয় হয় স্বপা, নার্গিস, রোকসানা সহ আরো অনেকের। গ্রুপ লিডার স্বপ্না আপা এই কেন্দ্রে সদস্য হিসাবে আছেন প্রায় আট বছর। তাঁর পরিবারের মুদির দোকান – স্বপ্না ও তাঁর স্বামী যৌথভাবে তা পরিচালনা করেন। স্বপ্না আপা শুধু যে বয়সেই সবার সিনিয়র তাই নয় – সামাজিক ও পারিবারিক অনেক বুদ্ধি–পরামর্শও উনি গ্রুপ মিটিং–এ সবার সাথে শেয়ার করেন। লোন আপা নিলুফা’র কাজে অনেক সহযোগীতা আসে স্বপ্না, নার্গিস, রোকসানা’দের বুদ্ধি–পরামর্শ।
আর এই সাপ্তাহিক গ্রুপ মিটিং–এই আসিয়া জানতে পারেন তাঁর পেটের প্রথম জীবন ‘মিসক্যারিজ’ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ – অল্পবয়সে গর্ভধারন, অপুষ্টি, অতিরিক্ত মানসিক ও শারীরিক চাপ গর্ভধারণের ৪ থেকে পাঁচ মাসের মাথায় গর্ভের ভ্রুণ নষ্ট করে দিতে পারে – যা প্রকারন্তরে ‘মিসক্যারেজ’ বা গর্ভপাত নামে পরিচিত। এনজিও’র এসব সভা থেকে আসিয়া বুঝতে পারেন অল্প বয়সে মা হবার না-না জটিলতার কথা। নিকটতম পারিবারিক স্বাস্থ্যক্লিনিকসহ সরকারী বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পর্কেও আসিয়া অনেক কিছু জানতে পারেন এই কেন্দ্রমিটিং থেকেই। বুদ্ধি-পরামর্শগুলি ভ্যানচালক স্বামী’র সাথে শেয়ার করতে ভুল করেন নি। তাঁদের যৌথ শলা-পরামর্শেই আসিয়া দম্পতি’র ঘর আলো করে আসে ছোট্য ‘ইশা খাঁ’, ভ্যান কেনার প্রায় চার বছরের মাথায়।
স্বল্প শিক্ষিত আসিয়া ও অশিক্ষিত স্বামী এবারে বুঝতে ভুল করেন না তাঁদের ভবিষ্যৎ করনীয় কি? ইশা খাঁ’কে পাড়ার স্কুলে ভর্তি’র ব্যাপারে বাবা-মা সজাগ। শিশু ইশাখাঁ’র জীবন বাঁচানোর সরকারী ১০টা টিকা [Expanded Programme on Immunisation (EPI)] নিতে ভুল হয়নি আসিয়াদের। বু্দ্ধিগুলি একটু একটু করে হলেও পেয়েছেন তাঁর এনজিও’র কর্মীসভা থেকে। রোকসানা আপার বড় ছেলে এখন অনার্স থার্ড ইয়ারে। রোকসানা আপার গল্পটাও অনেকটাই আসিয়া’র মতো – মা-বাবা’র সংসারে কদর না থাকলেও স্বামী তাঁকে কদর করতে ভুল করেন নাই। ঋণের টাকায় আয়ের চাকা দ্রুত হবার পাশা-পাশি স্বাস্থ্যসহ পারিবারিক ও সামাজিক অনেক দিকনির্দেশনার দৃষ্টিশক্তি উন্নত করতে ভূমিকা রেখেছে তাঁর এনজিও’র কর্মীসভা।
শেষের কথা:
গ্রুপভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম এদেশে একটা শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক কর্মকান্ড যা অনগ্রসর জনপদ বিশেষত: সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অর্ধশিক্ষিত ও দরিদ্র নারীদের তাঁদের প্রজনন স্বাস্থ্য, পারিবারিক কর্মকান্ড ও ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক দিকদর্শন আরো সুচিন্তিতভাবে গ্রহণে দারুণ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। প্রচুর পরিসংখ্যান থেকে এটা সহজেই অনুমেয় যে, গ্রুপ মিটিং-এর নিয়মিত আলোচনাগুলি আমাদের দেশের মহিলাদেরকে কেবলমাত্র আর্থিকভাবে সাবলম্বী ও সামাজিকভাবে সচেতনই করছে না, এর একটি বড় বাইপ্রোডাক্ট হলো নারী ও শিশু স্বাস্থ্য।
এই ব্যবস্থাপনাকে আরো শক্তিশালী করার উপায় কি?