ঋণসিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে করণীয় প্রশ্ন
যে প্রশ্নগুলির জবাব থাকাটা আবশ্যক:
ঋণসিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে করণীয় প্রশ্ন
যিনি ঋন পাবার জন্য আপনার কাছে এসেছেন, তার কাছে জানতে চান ঠিক কি কারনে তার টাকার প্রয়োজন এবং কত টাকা প্রয়োজন। জিজ্ঞাসা করুন কিভাবে তিনি লোনের টাকাটা কিস্তি (installment) হিসাবে ফেরত দিবেন, কত সময়ের মধ্যে দিবেন, কত সময় অন্তর দিবেন। লোন বিতরনের পরিমান, কিস্তির সাইজ ও সংখ্যা এবং শেষকিস্তি’র তারিখ ইত্যাদি থেকে ‘অংক’ করে বের করুন যে, সম্ভাব্য ঋনী সদস্য’র আবেদিত চাহিদার সাথে মাঠের বাস্তবতা মিলছে কিনা।
কাজ এখানেই শেষ নয়।
সরজমিনে যাচাই করতে হবে, এবং অবশ্যই। ধরুন, আলিফা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের প্রোপাইটর আলিফা’র বাবা আপনার কাছে ১ লক্ষ টাকা লোন চাইলেন ১২মাসের জন্য। ফ্ল্যাট মেথডে শতকরা ১২.৫ টাকা সুদে ১বছরে তার ঋণের মোট সুদ হয় ১২,৫০০ টাকা। এই হিসাবে তার মাসিক কিস্তির পরিমান দাঁড়ায় ৯,৩৭৫ টাকা। আলিফা’র বাবা খুব জোর গলায় আপনাকে বললেন এই টাকা দিয়ে তিনি দোকানের জন্য চলতি সম্পদ যেমন দুধ, ডিম, তেল সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবেন। আপনি দোকানে গেলেন, গিয়ে দেখলেন দোকানের শেলফগুলি ‘খালি খালি’! আপাত:দৃষ্টিতে আপনার মনে হলো আলিফার বাবা’র কথায়তো যুক্তি আছে, উনি তো দোকানের জন্য নতুন পণ্যই সংগ্রহ করবেন।
যে প্রশ্নের জবাব আপনার চাই, তাহলো –
১) আসলেই কি উনি নতুন পণ্যই কিনবেন? নাকি, পুরাতন ঋণ শোধ করবেন?২) দোকানের বিক্রি-বাট্টা দিয়ে উনি কিস্তি শোধ করতে পারবেন কিনা? ৩) ১ লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি আসলে কতদিনের চলতি সম্পদ ক্রয় করতে পারবেন? ৪) এই ১লক্ষ টাকাটা আদৌ তার প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট নাকি তা আলিফার বাবাকে আরো বেশী করে ঋণগ্রস্থ করবে? ৫) আলিফাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা কত? প্রতি মাসের পারিবারিক ব্যয় বাবদ আলিফার বাবাকে কত টাকা খরচ করতে হয়? ৬) ব্যক্তিগত বা সংস্থাগত ধার আরো আছে কিনা? ৭) আয় থেকে ব্যয় বাদ দেয়ার পরে কি কিস্তি ফেরতের টাকা হচ্ছে? ইত্যাদি।
জবাবের জন্য আপনার চেষ্টাটা কিরকম হবে?
উপরের প্রশ্নগুলি করা সহজ হলেও এর উত্তর পাওয়া সহজ না। আবার সব প্রশ্নের উত্তর যে আপনি শতভাগ সঠিক পাবেন তাও প্রত্যাশা করবেন না। তবে, একটা ভাত টিপে যেরকম পুরো হাড়ির ভাতের অবস্থা জানা যায়, এখানেও সেই যুক্তি কিছুটা হলেও খাটাতে পারেন। তথ্যের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা, ব্যক্তি’র কথা মূল্যায়ন করার দক্ষতা – ঋণ সিদ্ধান্ত নিতে আপনাকে অনেকটাই সাহায্য করতে পারে।
সরজমিনে আলিফা স্টোরে গিয়ে দেখুন। দোকান যিনি চালাচ্ছেন তার সাথে কথা বলুন। দোকানে কে বসে আছেন – কর্মচারী একা, নাকি আলিফার বাবাও আছেন? কর্মচারী কি চটপটে আছেন? বেচা-কেনা কেমন হচ্ছে খেয়াল করুন। বিক্রি কি বাকিতে হচ্ছে না নগদে? বাকি’র খাতাই যদি মোটা হতে থাকে তাহলে সতর্ক হওন।
আলিফাদের বাসায় যান। কিছু সময় তাদের ওখানে বসুন – আলাপ করুন আলিফার মা’র সাথে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে। বাসার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। গল্পোচ্ছলে জানতে চাইতে পারেন তাদের পরিবারকে আরো কোনো কিস্তি চালাতে হয় কিনা। ঋণের পরিমান কত, কতগুলি লোন বর্তমানে চালাতে হচ্ছে আলিফার বাবাকে – অথবা, আদৌ কোন লোন আছে কিনা!
আশেপাশের দু’এক পরিবারের সাথে কথা বলুন না ! তাদের কাছে আলিফাদের পরিবারের কোনো দায়-দেনা আছে কিনা খোঁজ নিন। বাসায় বউ-জামাই-য়ের ঝগড়া কেমন চলে – কি ব্যাপারগুলি নিয়ে ঝগড়া করেন স্বামী-স্ত্রী? কিছুটা স্পর্শকাতর হলেও – এগুলি কিন্তু খুবই উপকারী ক্লু হতে পারে আপনার ঋণ সিদ্ধান্তের জন্য।
আপনি তো এনজিও কর্মী – আশে-পাশে’র আরো এনজিও কর্মী বা সমবায় সমিতি’র মাঠকর্মী’র সাথে আপনার সদ্ভাব থাকাটা আপনার কাজের জন্য উপকারী হতে পারে। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন – অন্য এনজিও’তে আলিফার বাবার কোন কিস্তি চলছে কিনা খোঁজ নিতে পারেন! ব্যবসা বা পারিবারিক প্রয়োজনে একজন ব্যক্তি বা উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী একাধিক ঋণ নিতেই পারেন। আলিফার বাবাও একাধিক ঋণ নিতে পারেন। আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে, আলিফার বাবার কথা আর চলমান বাস্তবতা মিলছে কিনা – যদি তফাৎ পান, তবে সতর্ক হওন!
দ্বিতীয় যে কারনে, অন্যান্য ঋণ প্রাপ্তির ব্যাপারে খোঁজ নেয়া দরকার তাহলো উনার ব্যবসার আয়ের সাথে ঋণের কিস্তিসহ পারিবারিক ও ব্যবসার খরচের পার্থক্যটা কি ধনাত্মক নাকি ঋণাত্মক দাঁড়াচ্ছে তা বুঝতে পারা। ঋণাত্মক হলে তো ‘বিগ নো’!
আলিফার বাবা কি যথেষ্ট উদ্যোমী – হ্যাঁ। তবে আগে ছিলেন, এখন আর অতটা নন। কেমনে বুঝলেন? উনার মুখের কথায়? না। তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ কি বলে? তার চোখ ও শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন। আমাদের মুখের কথার থেকে আমরা শারীরিক ভাষায় ‘সত্য’কে প্রকাশ করি অনেক অনেক বেশী। যেকারনে, প্রেমিকের লক্ষ-কোটি ‘আই লাভ ইউ’ শোনার পরেও প্রেমিকার মন গলে না!
আর হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়।
আলিফার বাবা মানুষ হিসাবে কেমন? ঋণের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলে উনি কি সহজভাবে নিতে পারেন নাকি কথায় কথায় ‘মেজাজ’ দেখান। মনে রাখবেন, ঋণী সদস্য’র মেজাজ বা এটিচিউড (Attitude) প্রবলেম কিন্তু পরবর্তীতে একজন লোনঅফিসারের জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে পারে – কিস্তি যদি অনিয়মিত বা খেলাপী হয়ে পড়ে!
সবশেষ কথা:
সংস্থা থেকে আপনার টার্গেট আছে – আমি জানি। টার্গেট এচিভ করার পেরেশানি আপনার আছে – সেটাও জানি। কিন্তু, টার্গেট ফিলাপ করতে গিয়ে আপনি যদি ভুল ধারনা বা তথ্যের উপর ভর করে একটা বাজে ঋণ চুক্তি করে ফেলেন, তাহলে কিস্তি’র পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার শ্রমঘন্টার সিংহভাগ সময় চলে যেতে পারে। ঋণের সাইজ ছোট হলে তো তাও অল্পের উপর দিয়ে আপনি ঋণঝুঁকি বিশ্লেষণ করতে পারেন; কিন্তু, ঋণ আবেদনের পরিমান বেশি হলে অথবা, ঋণের ডিসবার্সমেন্টের পরিমান যদি বেশী করতে চান – অবশ্যই সময় দিতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে, ঝুঁকি বিশ্লেষণ করতে হবে।
মনে রাখবেন – ‘সঠিক ঋণ বিতরন, সহজে কিস্তি আদায়’।
আবেদিত সদস্যর আয় যেন অবশ্যই ঋণের কিস্তিসমেত মাসিক অনুমিত মোট ব্যয়ের থেকে বেশী বৈ কম না হয়।
অংকটা ঠিকমতো করতে জানলে আপনাকে আর ঠেকায় কে!… (১ম অংশ পড়ুন)