ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?
প্রচলিত আছে ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম কার্যকরভাবে শুরু হয় আমাদের এই বাংলাদেশে। আঠারো কোটি জনসংখ্যার দরিদ্র এই দেশে ১মবারে মতো সমিতিভিত্তিক সফল ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু হয় ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের মাধ্যমে । আর এই ক্ষুদ্রঋণের কনসেপ্ট যে মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে সমর্থ হতে পারে তা ড: মু: ইউনুস ও তাঁর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান গ্রামীন ব্যাংকের নোবেল প্রাপ্তি’র মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারেন।
গল্প দিয়ে শুরু করা যাক…
দুইটা উদাহরণ লক্ষ্য করি।
আমি যে এলাকায় থাকি, ওখানে একটা শেডওয়ালা কাঁচাবাজার আছে। কাঁচাবাজারের একপাশে তরিতরকারী’র দোকান থাকলেও অন্য আরেকপাশের বেশকিছু দোকানে ডিম ও কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমী দেশী ফল বিক্রি করে। ডিমগুলি বেশ বড় বড়, – ছোটবেলার হাঁসের ডিমগুলিই শুধু বড় ছিলো, তুলনামূলকভাবে। আর এরকম দোকানের সংখ্যা ওই মার্কেটে প্রায় সাত-আটটি।
বড় আর পরিষ্কার একডজন মুরগীর ডিম কেনার সময় কোন এক সন্ধ্যায় দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলাম বাজারের সমান একই দাম রেখে এরকম বড় ডিম বিক্রি করলে তার কোন লাভ হয় কিনা? পান-খাওয়া মুখে একগাল হেসে ঝরনা খাতুন বললেন, আমাদের তো বিক্রি বেশী! বুঝলাম, ওনার ব্যবসায় আনন্দ আছে, দু:খ কম। এরপরে কথায় কথায় জানতে পারলাম, তাঁর ডিমের চালানের অর্থলগ্নী হয়েছে কোন একটা সমবায় সমিতি’র ক্ষুদ্রঋণের কল্যানে। উনি খুশি। স্বামী রিকশা চালালেও উনি গর্বের সাথে জানালেন, কামাইটা তার’ই বেশী। দুই ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছেন এবং বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ উনিই বহন করে যাচ্ছেন। কিস্তি দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত। (ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?)
আরেকটা সত্য গল্প বলি।
আমাদের পাড়ার রাস্তার মোড়ে দু’টো দোকান দেখছি অনেক বছর থেকেই। দুটো’ই মুদি দোকান। আয়তনে প্রায় সমান দু’টো দোকান পাশাপাশি। টাক মাথার ফর্সা চেহারার রুস্তমের দোকানে দোকানী একাই এবং সে হোলো রুস্তম। এবং পাশের দোকানের মালিকানা সেই করোনার আগে থেকেই দেখে আসছি পরিবর্তন হয়ে আসছে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। যদিও এই দোকানের পজিশন, রুস্তমের দোকানের থেকে বেটার, কারন কর্ণারপ্লট। ৪টা গলির এই কর্ণারের দোকানের স্বাভাবিক আকর্ষন থাকা সত্ত্বেও ফিবছর এর মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে। (ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?)
রুস্তম দেখতে আকর্ষণীয় হলেও, তার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে গম্ভীর, কাজেই অন্যান্য খরিদ্দারদের মতোই ঘরের কাছের মুদি সদাই হিসাবে ‘মা জেনারেল স্টোর’ নামের কর্নারের এই দোকানটা আমারও পছন্দের। একদিন, দোকানী কামালের সাথে আলাপ জুড়লাম। কথা থেকে যেটা বের হলো, কামাল একজন কর্মচারী বৈ, কিছু না। বর্তমান মালিকও দোকানের পজিশন ছেড়ে দেয়ার চিন্তায় আছে – ভাল কোন খরিদ্দার পেলে সে তা ছেড়ে দিবে। কেন? কেন? কারন হিসাবে সমিতি’র কিস্তি, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারী’র বেতন আর বাকি’র খরচ সবকিছু যোগ করার পরে নাকি মাস শেষে মালিকের উল্টো আরো কিছু টাকা না পুরলে পরের মাসের সদাই কেনার ‘মূলধন’ যোগাড় হয় না। এহেন ‘উল্টো ম্যাথে’র যন্ত্রনায় মালিক দোকানের পজিশন ছেড়ে দেয়ার জন্য উতলা হয়ে আছেন। বলাই বাহুল্য, ‘মা জেনারেল স্টোর’-এর এই গল্পটা সম্ভবত: ফিবছর একই থাকে।
অন্যদিকে রুস্তমকে আমি এই পাড়ায় আসার পর থেকে কখনও দোকান ছাড়া বাইরে কোথাও দেখিনি, শুধুমাত্র শুক্কুরবার জুম্মা’র নামাজের সময় মসজিদের সামনের রাস্তায় পাটি বিছিয়ে নামাজের জন্য দাঁড়ানো ছাড়া! তার কি এনজিও’র লোন নাই, জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য একবার ওকে বলতে শুনেছি, ‘আমার নিজের হাতে কাজ করতে ভালো লাগে’!
উপরের দু’টো গল্পই আমাদের আশেপাশের প্রাত্যহিক জীবন থেকে নেয়া, যেখানে দু’টো দোকানীই তাদের ব্যবসার তারল্য সম্পদ বৃদ্ধি’র জন্য ক্ষুদ্রঋণের দারস্থ হয়েছেন – একজন হাসিমুখে (অব্যক্ত) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, অপরজন সুফলটা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন।
দায়ী কে?
ঘটনা দু’টো থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এনজিও বা সমবায় সমিতিগুলো আমাদের প্রাত্যহিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে আমাদের সংকটকালীন তারল্য মোকাবিলায় সহযোগীতা করেন। কিন্তু, আমরা যদি তা সঠিক পদ্ধতিতে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই, তা আমাদেরকে শুধু ঋণগ্রস্থই করে না আমাদের জীবনের সুখও কেড়ে নিতে পারে!
তাহলে উপায়?
বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিও’র সংখ্যা ৭০০+ এবং আরও প্রায় ৩০০-র অধিক প্রতিষ্ঠান এমআরএ (MRA) থেকে অস্থায়ী সনদের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এছাড়াও হাজারো সমবায়ী প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আনাচে-কানাচে তাদের সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বিভিন্ন অনলাইন সার্চ ব্যবহার করে এটা খুব নির্ভরযোগ্যভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রতি ৪জনের মধ্যে ১জন ব্যক্তি কোন না কোন ভাবে ক্ষুদ্রঋণ নির্ভর (এনজিও-এমএফআই, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, সরকারী ও বেসরকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি), যাদের ৯০ শতাংশই নিয়মিত এই ঋণ পরিশোধ করে আসছেন। যদি এই সংখ্যাগুলি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে একথা অস্বীকার করার কি কোন উপায় আছে যে, ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারে মানুষ দারিদ্য থেকে মুক্তি পেতে পারেন, নিজের জীবনমান উন্নত করতে পারেন?
আমাদেরকে জানতে হবে ঋণ-প্রাপ্তির পূর্বের সঠিক অংক কষতে এবং নির্ধারণ করতে হবে ঋণের সঠিক ব্যবহার ও ফেরতের পূর্ণাংগ কর্মপন্থা। তাহলেই আমরা পেতে পারি ঝরনা খাতুনের তৃপ্তিমাখা হাসি’র আড়ালে একজন স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী উদ্যোক্তা’র গল্প, ঘরে ঘরে।
পুন:শ্চ:
‘মা জেনারেল স্টোর’ আর নাই – নতুন দোকানের নাম ‘ওয়াশকুরুনী অটো ড্রাই ক্লিনার্স’। নতুন মালিককে এখন দোকানের শেলফ ভরাট করতে কিস্তি গুণতে হয়না, বাকিতে পণ্য বিক্রির প্যারাও নাই।
দেখা যাক কি হয়….
বিশ্লেষণধর্মী লেখা। ভালো লাগলো পড়ে।
ওয়াশকুরুনি স্টোর এর কি হলো সেটা পরবর্তিতে জানানোর অনুরোধ রইলো!