ক্ষুদ্রঋণ এনজিওতে ক্যারিয়ার গড়ার আগে যেসব বিষয় ভাবা জরুরি

NGO চাকরি

অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের কাজের স্তর ‘পিরামিড’এর ন্যায়, যেখানে পিরামিডের সর্বোচ্চ চূড়ায় থাকেন তার নির্বাহী প্রধান। বাংলাদেশে এনজিও বা এমএফআইগুলি প্রধাণত: পিরামিড সজ্জায় কাজ করে থাকে। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি’র প্রধান হন একজন নির্বাহী পরিচালক বা এক্সিকিউটিভ ডিরেকটর এবং একেবারে বেসমেন্টের গাঁথুনী তৈরী করেন মাঠকর্মী বা ফিল্ডঅফিসার (Field Officer) বা ক্রেডিট অফিসার (Credit Officer), যে নামেই ডাকুন না কেন।  NGO চাকরি

ক্ষুদ্রঋণ এনজিওতে মাঠকর্মীর ভূমিকা অপরিসীম:

NGO চাকরি

ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনাকারী এনজিওগুলি’র ক্ষুদ্রতম ইউনিট হলো ‘মাঠকর্মী’ বা ক্রেডিটঅফিসার।পজিশন বা নামটা ছোট শোনালেও একজন মাঠকর্মী’র কাজের পরিধি কিন্তু বিস্তৃত। কোনরকমে নাস্তাটা শেষ করেই উনি সকাল সকাল ফিল্ডে চলে যান। সমিতিতে এসে তড়িৎ সকলের সাথে কুশল বিনিময় করেই লেগে পড়েন ওই সমিতি’র মূল কর্মসূচীতে – ঋন ও সঞ্চয়ের কিস্তি উত্তোলনে। সবাই কি তাঁর হাতে ঝটপট নগদ টাকা এনে দিয়ে কিস্তি শেষ করে চলে যান?

অনেক সময় তা সত্য হলেও সবাই কিন্তু, কিস্তি’র টাকাটা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারেন না। একজন মাঠকর্মী দিনে অন্তত: ২ থেকে ৪টা সমিতিতে যান ঋণকর্মসূচী পরিচালনা করার নিমিত্তে। এই কাজগুলো পরিচালনা করে তাকে আবার ছুটতে হয় বকেয়া সদস্যদের বাড়ি বাড়ি বা ব্যবসা’র স্থানে – অনুনয়-বিনয় অথবা শক্ত হয়ে তাকে ঋণের কিস্তি আদায় করতে হয়, রোদ-বৃষ্টিকে থোড়াই কেয়ার করে! সবশেষে ব্রাঞ্চে বা শাখায় এসে হিসাব মিলাতে হয় – হাতে নগদের সাথে সমিতির মূল হিসাবের। NGO চাকরি

অনেক সংস্থায় এসকল কাজ করতে গিয়ে একজন কর্মী’র রাত আটটা-দশটা হয়ে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক না।

মূলত: মাঠকর্মী’র সততা, দায়িত্বপূর্ণ আচরণ ও কর্মদক্ষতার উপর ওই সংস্থা’র ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল। এখন প্রশ্ন হলো, ঋণকার্যক্রম এনজিও’তে ক্যারিয়ার তৈরী করতে হলে আপনি কোন বিষয়গুলিকে বিবেচনায় নিবেন? শুধুমাত্র ‘বেতন’টাই কি সব, নাকি আরো কিছু বিষয় বিবেচনায় নিবেন সংস্থা নির্বাচনে?

চলুন দেখে নেই।

কাজের পরিবেশ:

বাংলা ব্যাকরণে পড়েছেন নিশ্চয়ই ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম সম্পাদন’ হয়। কর্তা যেভাবে তাঁর সংস্থাকে পরিচালিত করতে চান, মূলত: কর্মপরিবেশ তারই প্রতিফলন। উনি যদি ‘বদরাগী’ হন, আপনার ইমিডিয়েট উপরের একাউন্টেন্ট বা শাখা ব্যবস্থাপক’ও তারই প্রতিরূপ হবার সম্ভাবনা বেশী। আপনার ইমিডিয়েট বস হলেন শাখা ব্যবস্থাপক অথবা, কোথাও কোথাও সহকারী শাখা ব্যবস্থাপক অথবা একাউন্টেন্ট – তাঁর দৈনন্দিন আচরণ ও ব্যবহার আপনার কাজের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য। অনেক বস আছেন, অধ:স্তনের কাজ শেষ হয়ে গেলেও, তাঁকে অফিস থেকে বের হতে দেখলে তেলে-বেগুনে জ্বলতে থাকেন। এই টাইপের বসের কাছে কাজের অগ্রগতি মানেই হলো অধিক সময়ে অফিসে ব্যয় করা। অনেক কর্মীই দিনের পর দিন অধিক সময়ে অফিসে ব্যয় করে দ্রুতই শারীরিক ও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ফলে, মূল যে কাজ ঋণকার্যক্রম, তা দ্রুতই ব্যাঘাতগ্রস্থ হয়।

আবার, এই টাইপের বসরা কর্মীদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক বা সামাজিক প্রয়োজনে ছুটি নেওয়াটাও সহ্য করতে পারেন না। তাঁরা মনে করেন, চাকরি মানেই রাতের ঘুম ছাড়া বাকি সময়টা অফিসে ব্যয় করতে হবে – এখানেই সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান-কর্মযজ্ঞ করে যেতে হবে। একজন কর্মী’রও ব্যক্তিগত জীবন-পরিবার-সমাজ থাকতে পারে অথবা, অফিসের বাইরে বিভিন্ন প্রয়োজনে তাঁর ‘ছুটি’র প্রয়োজন হতে পারে তা এককথায় বেমালুম ভুলে যান এধরনের বস’রা। এসব লোকের আন্ডারে কাজ করা কিন্তু সহজ নয়। ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স যে বর্তমান দুনিয়ায় কর্মপরিবেশে একটি বহুল প্রচলিত শব্দ, কোন কোন সংস্থায় আপনি তা নাও পেতে পারেন।

সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা ট্রেনিংএর অভাব:

সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা অবলম্বন না করার কারনে অনেক সংস্থার ঋণকার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। মনে রাখতে হবে, এদেশে ঋণ নেয়ার মানুষের অভাব নাই, কিন্তু, অনেকেই নানাবিধ কারনে সময়মতো কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন। ঋণ কার্যক্রমে অন্যতম পন্থা হলো সঠিক দিকনির্দেশনা – কোন ধরনের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাকে লোন দেয়া যাবে তা সংস্থা কর্তৃক সঠিকভাবে নির্নীত হতে হবে।

ঋণ আদায়ে কি কি পন্থা অবলম্বন করতে হবে, ঋণের ক্লাসিফিকেশন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী ফলোআপ ব্যবস্থাপনা কি কি হতে হবে – তা অবশ্যই সংস্থা’র কার্যক্রমে লিপিবদ্ধ থাকতে হবে। শুধু লেখা থাকলেই হবে না সময় সময় এই বিষয়গুলি নিয়ে অফিসে আলোচনা ও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এগুলি ব্যতিরেকে কেবলমাত্র ঋণকর্মী বা মাঠকর্মী’র উপর ‘টার্গেট’ ধরিয়ে দিলে তা আসল উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হতে বাধ্য।

এনালগকে না বলুন:

যদি বর্তমান সময়কে ‘ডিজিটাল’ বলি, তাহলে অটোমেশন না থাকাটাকে ‘এনালগ’ বলতে পারি, তাই না? বর্তমান যুগ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, ‘এনালগ’ পদ্ধতিতে ম্যানুয়ালী ঋণ-সঞ্চয়ের খাতা-কলমের হিসাব আর কতোদিনই বা সম্ভব হবে? অনেক সংস্থাই তাদের ঋনকার্যক্রম স্বয়ংক্রিয় করার প্রয়াসে ইতোমধ্যে সফটওয়্যার পরিষেবা গ্রহণ করেছেন। অনেক সংস্থা সফটওয়্যার অটোমেশনের কথা চিন্তা-ভাবনা শুরু করেছেন। আর বাকি’রা বসে আছেন খাতা-কলমের সেই যুগে!

আপনাকে বেছে নিতে হবে অটোমেশনে যাবেন নাকি এনালগে যাবেন! আর হ্যাঁ, বাজারে তো অনেকগুলি ক্ষুদ্রঋণ ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার আছে ঋণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। সবগুলোর হিসাব-নিকাশ এবং সেবার মান কিন্তু এক নয়। অনেকসময়ই সফটওয়্যার নিয়ে সফটওয়্যার বাগ বা ত্রুটি’র কারনে কাঙ্খিত সেবা পাওয়া যায় না – হিসাব মিলানোটা হয়ে যায় ‘মারণফাঁদ’।

ঋনকার্যক্রম পরিচালনাকারী সফটওয়্যার এদেশে প্রচলিত অন্যান্য সফটওয়্যার পরিষেবা’র তুলনায় কিছুটা জটিল ও ভিন্নতর। ফলশ্রুতিতে অনেক প্রতিষ্ঠানই এই সফটওয়্যার কার্যক্রম শুরু করলেও শেষমেষ ঠিকমতো শামাল দিতে পারেন না। জটিল বাগের (Bug) কারনে, দিনের পর দিন সংস্থার ঋণকার্যক্রম ভুল হিসাব মেনেই চালিয়ে যেতে হয় – যার মাশুল দিতে হয় যারা মাঠপর্যায়ে ঋণকার্যক্রমে জড়িত থাকেন। বাজারের যেনতেন ‘সস্তা’ সফটওয়্যার ক্রয় করে সংস্থার কর্মীদের জন্য বয়ে আনে প্রাত্যহিক দু:স্বপ্নের ভয়াবহতা – রাতের পর রাত জেগেও ঋণ-সঞ্চয়ের হিসাব মিলানোটা হয়ে ওঠে কষ্টকর। ভাল মানের ক্ষুদ্রঋণ ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার সহজেই এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে।

সংস্থা’র এই বিষয়টাও আগে-ভাগে জেনে রাখাটা এবং সে অনুযায়ী সংস্থা নির্বাচন করাটা আপনার মানসিক স্বাস্থ্য ও সর্বোপরী ক্যারিয়ারের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করি।

 

খোঁজ নিবেন কিভাবে?

আপনি যদি ক্যারিয়ার (এনজিও) শুরু করতে চান অথবা, ক্যারিয়ারের মধ্যপথে সংস্থা পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে থাকেন তবে উপরের বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে পথ চলার চেষ্টা করুন। এখন প্রশ্ন হলো, সংস্থা সম্পর্কে তথ্য কোথায় পাবেন? অনেকভাবেই আমরা একটা প্রতিষ্ঠান, তাদের কর্মপরিবেশ, কাজের মান, সংস্থা’র স্টাফদের মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।

একটা বড় মাধ্যম হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম – ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ, পেজ, লিংকডইন, ওয়েবপেজ সহ আরো বিভিন্ন ভাবে আপনি একটা সংস্থা সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পেতে পারেন। এরপরেও আপনি ঐ সংস্থায় কর্মরত (অতীতে বা বর্তমানে) স্টাফদের সাথে কথা বলে সংস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারেন। NGO চাকরি

এতকিছু চিন্তা-ভাবনার পরেও যদি আপনি ‘ফ্রম ফায়ারপ্যান টু ফায়ার’-এ পড়ে যান, নতুন আরেকটি সংস্থাকে বেছে নেয়ার স্বাধীনতা তো আপনার থাকছেই…

লেখকঃ আ.ই মুকসিত (এক্স ব্যাংকার)

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest

0 Comments
Most Voted
Newest Oldest
Inline Feedbacks
View all comments
bn_BD
Scroll to Top
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x