যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না।
ক্ষুদ্রঋণের বাস্তবতা:
যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না।
সুন্দর মুখের প্রেমে পড়া আর অন্যকে টাকা ধার দেয়া দু’টিই খুব সহজ কাজ। অর্থ কেন প্রয়োজন? এই প্রশ্নের জবাব আছে অগনিত। প্রয়োজন না থাকলেও ‘প্রয়োজনীয়’ বানানোর তরিকা আছে শত শত।
দুনিয়াতে চলতে গেলে অর্থ বা টাকা-পয়সাই যেহেতু প্রধানতম মাধ্যম, কাজেই ‘কেন আমার অর্থ দরকার’ এই প্রশ্নের শত-হাজার জবাব রয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দুনিয়ার শতকরা ১০ ভাগ সবচেয়ে ধনী মানুষের কাছে দুনিয়ার মোট সম্পদের ৮৫ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত রয়েছে! আরো একটি তথ্য দেই –দরিদ্রতার দিক থেকে নীচে অবস্থান করা পৃথিবীর শতকরা ৫০ ভাগ মানুষের কাছে আছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। কি অবাক হচ্ছেন?
ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য [Poverty, Prosperity and Planet Report 2024] অনুযায়ী পৃথিবীতে ৩৫০ কোটি মানুষ (৪৪ শতাংশ) দারিদ্রসীমার (যাদের দৈনিক আয় ৬.৮৫ ডলারের কম) নীচে বাস করে, যা কিনা এতো এতো প্রযুক্তিগত উন্নতি সত্বেও গত প্রায় ৩৫বছর ধরেই অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য মতে বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন।
এই দরিদ্র মানুষগুলি’র পক্ষে তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাইরের অন্যকোন ‘প্রয়োজন’ মিটানোটা দারুন কষ্টসাধ্য। এই বিপুল জনগোষ্ঠী কোন না কোনভাবে অর্থের সন্ধানে তাদের জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করে চলেছেন। আমরা যখন ফেসবুক বা অন্যকোন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সফটওয়্যার স্বস্তি’র mfi247 অথবা coopBank247-এর প্রোমোশন করি, তখন সিংহভাগ রেসপন্ড পাই তাদের কাছ থেকে যারা কোন না কোন কারনে ক্ষুদ্রঋণ নিতে আগ্রহী, সফটওয়্যার সেবা নয়।
এদের অনেকে গৃহস্থ, ছাত্র, ক্ষুদ্রব্যবসায়ী, গৃহিনী। তাদের প্রয়োজনটা যেমন অমূলক নয়, তেমনি তাদের প্রয়োজনটা দেশের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঋণ কর্মসূচীতে নিয়োজিত এনজিও বা সমিতিরাও সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে মিটাতে পারছেন না।
ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ও ক্রেডিট অফিসার:
এদেশে বর্তমানে সাতশ’র উপরে এমএফআই (MFI) ও কয়েক হাজার সমবায় সমিতি বা কোঅপারেটিভ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে নিয়োজিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মূল কাজ হলো ঋণ দেয়া ও তা আদায় করা। সাথে থাকে সঞ্চয় জমা ও উত্তোলন। নিরলসভাবে যিনি এই কাজটি করেন তিনি হলেন মাঠকর্মী (Field Officer) বা ক্রেডিট অফিসার (Credit officer)। তাঁদের কাজ পরিশ্রমসাপেক্ষ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময়সাপেক্ষও বটে।
বাংলাদেশে ঋণ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক – এখানে আইন আছে, কিন্তু ঋণ খেলাপী বা তামাদি হলে তার প্রয়োগটা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য – অনেকক্ষেত্রেই বাস্তবতার সাপেক্ষে বাস্তবায়ন অযোগ্য। আমরা বড়দের দিকে তাকিয়ে আমাদের নিজেদের চলার পথ তৈরী করার প্রয়াস পাই। এনজিও বা সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য পথিকৃত যদি হয় দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তাদের পোর্টফোলিও’র ঋণ খেলাপী সংস্কৃতি আমাদের জন্য খুব একটা আশার বানী শোনাবে না। ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী দেশের ব্যাংকিং খাতে বিতরন করা ঋণের ২৫ শতাংশই এনপিএল [NPL, Non Performing Loan]।
অর্থাৎ, ব্যাংকগুলির এই ঋণ ফেরত পাবার সম্ভাবনা আমাদের দেশের ঋণ কালচারের বাস্তবতায় ‘সাগর সেঁচে মুক্তো পাবা’র মতোই স্বপ্নসাধ্য ব্যাপার!
আপাতদৃষ্টিতে ভাল মানুষটা ঋণ পাবার পরে দেখা যায় ব্যবসায় মন্দা বা অন্য কোন কারনে এনজিও’র ঋণ আর ফেরত দেন না বা দিতে পারেন না – ঋণদাতার সাথে সম্পর্ক হয়ে যায় সাপে-নেওলে।
যিনি এই সম্পর্কের সেতুবন্ধন করেন, তিনি একজন লোনঅফিসার বা ক্রেডিটঅফিসার অথবা বলা যায় মাঠকর্মী।
এই লেখার কেন্দ্রিয় চরিত্র হলেন একজন মাঠকর্মী, যিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করেন সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষদেরকে নিয়ে। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁকে ছুটতে হয় সমিতি থেকে সমিতিতে কিস্তি আদায় এবং বাসা-বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বকেয়া আদায়ে।
তারপরে অফিস টাইমের পরে সময়টা যায় দৈনন্দিন হিসাব মিলাতে, কখনো কখনো রাত জেগে। তার প্রাইভেট লাইফ অনেকটাই বিশৃঙ্খলার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে – মন্দ ঋণ বা কুঋণের যন্ত্রণায়। কাজেই, মাঠকর্মী’র কাজ অত্যন্ত চ্যালেন্জিং। ঋণ ও ঋণী নির্বার্চনের ত্রুটি তাঁর পেশাগত জীবনকে করে তুলতে পারে দারুনভাবে অনাকাঙ্খিত।
তাই, হাজারো ব্যস্ততার ভীড়ে একজন ঋণকর্মী বা মাঠকর্মীকে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে সঠিকভাবে ঋণ ও ঋণী নির্বাচন করতে হবে।
মুখের কথায় চিড়ে ভিজতে দিবেন না:
একজন এনজিও বা সমবায় সমিতির মাঠকর্মী কাজ করেন প্রত্যন্ত গ্রামে, শহরের অলি-গলিতে। তাঁর এলাকার সবাই তাঁকে ‘লোনআপা’ বা এনজিও কর্মী হিসাবে চিনেন। যে আজ তাঁকে চিনেন না, টাকার দরকার পড়লে তিনিও আগামীকাল তাঁকে চিনে নেন। আর এটাই হোলো বাস্তবতা।
মাঠকর্মী’র থাকে টার্গেট বিতরনের (Loan Disbursement) চ্যালেন্জ – উনি নিজের উদ্যোগে খুঁজেন সম্ভাব্য ভাল সদস্য। টার্গেট বাজেটের চাপে অনেকসময়ই সঠিক মানুষটিকে বেছে নেয়াটা দুষ্কর হয়ে যায় তাঁর জন্য। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একজন নিডি (needy) মানুষ তাঁর প্রয়োজন মিটাতে অনেকগুলি কথা বলতে পারেন – যার অধিকাংশই হতে পারে প্রয়োজনের তাগিদে বাস্তবতাবর্জিত। আমাদের বর্তমান সমাজের বাস্তবতায়, অনেকক্ষেত্রে আমরা সত্যটা গোপন রেখে হলেও আমাদের প্রয়োজনটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি – যেকারনে শুধু মুখের কথাগুলি সর্বদা বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে।…. (২য় অংশ পড়ুন)