Blog

গ্রুপভিত্তিক মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম
Blog

গ্রুপভিত্তিক মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম:বাইপ্রোডাক্টের গুরুত্ব

গ্রুপভিত্তিক মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম বাইপ্রোডাক্টের গুরুত্ব গ্রামীন ব্যাংকের মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রাম চালু হয় মহিলাদের গ্রুপভিত্তিক ঋণদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে। কোলাটেরাল বা জামানতবিহীন এই ঋণে একের দায়ে গ্রুপের অন্য সদস্যদেরও অলিখিতভাবে একাউন্টেবল করা হয়। যাদেরকে প্রচলিত পদ্ধতি ঋণ পাবার অযোগ্য মনে করেছিলে, কালের পরিক্রমায় তারাই হয়ে ওঠে এদেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ঋণী (Debtor)। এদেশে ব্যাংকব্যবস্থাপনায় যেখানে খেলাপী ঋণের পরিমান প্রায় এক তৃতীয়াংশ, জামানতবিহীন এসকল ঋণী’র কাছ থেকে ঋণ ফেরতের হার পঁচানব্বই শতাংশ’র বেশী। গ্রামীন ব্যাংকের গ্রুপভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থাপনার এ মডেল দ্রুতই ব্র্যাক, আশা সহ আরো সহস্রাধিক এনজিও’কে আকৃষ্ট করে। ছড়িয়ে পড়ে গ্রাম থেকে শহরের আনাচে-কানাচে। গ্রামীন ব্যাংক ও তার প্রতিষ্ঠাতা ড: মুহম্মদ ইউনুসকে এনে দেয় নোবেল শান্তি পুরষ্কার।  ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচীর এই আখ্যানে প্রচলিত ঋণ ও সঞ্চয় কার্যক্রমের গল্পটি নতুন না। এবং এই লেখার উদ্দেশ্যও ঋণ প্রাপ্তি বা কিস্তি প্রদানের তথ্যে নিহিত নয়।  গ্রুপমিটিং – সমিতি বা গ্রুপভিত্তিক মাইক্রো-ক্রেডিট প্রোগ্রামের অন্যতম অংশ: গ্রামীন ব্যাংকের আদলে এদেশে কোলেটরাল বা জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের যে বিপ্লব ঘটেছিলো তা ছিলো মূলত: গ্রুপলেন্ডিং বা সমিতিভিত্তিক ঋণ কার্যক্রম। প্রাথমিকভাবে এখানে পাঁচজন সদস্য’কে নির্বাচিত করে একটা গ্রুপ গঠন করা হয়েছিল, যাদের ঋণফেরতের ধরনের উপর ভিত্তি করে সদস্য বৃদ্ধি-হ্রাস সহ ঋণের পরবর্তী দফার পরিমানও নির্ভর করতো। উল্লেখ্য যে, গ্রুপভিত্তিক এই ঋণ কার্যক্রমের মূল বেনেফিশায়ারি হলো নারী। একজন প্রশিক্ষিত ঋণকর্মী (Credit Officer) বা মাঠকর্মী (Field Officer) সাপ্তাহিক সমিতি মিটিং-এ ঋণের কিস্তি, সঞ্চয়ের কিস্তি আদায়, প্রাপ্ত ঋণের ব্যবহার, ঋণলব্ধ প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা, ব্যবসা সংক্রান্ত পরামর্শ ছাড়াও আরো কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা বা পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তাঁর এই আলোচ্যসূচীর মধ্যে স্থান পায় সামাজিক দায়বদ্ধতা, পারিবারিক বিভিন্ন পরামর্শ, মাতৃমঙ্গল, মহিলা ও শিশুসহ সাধারন স্বাস্থ্যগত পরামর্শ। গ্রাম ও শহরের অপেক্ষাকৃত অনগ্রসর জনপদ ক্ষুদ্রঋন কর্মসূচীর প্রধানতম উপকারভোগী। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে মহিলারা তাঁদের পরিবারে পুরুষদের অধিনস্ত – নিম্নবিত্ত বা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে এই চিত্রটি আরো বেশী সত্য। অশিক্ষা বা কুশিক্ষার প্রভাবে সাধারণ দরিদ্র পরিবারে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত শিক্ষা বা জ্ঞানের প্রবাহ অপ্রতুল। এমনতর পরিস্থিতিতে একজন প্রশিক্ষিত মাঠকর্মীর বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যগত পরামর্শ গ্রুপের সদস্যদের জন্য অনেকক্ষেত্রেই দারুন উপকার বয়ে আনে। একজন অভিজ্ঞ মাঠকর্মী শুধু স্বাস্থ্যগত পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত হোন না, উনি সদস্যদেরকে তার ব্যবহারিক দিকনির্দেশনা, পরিষেবা প্রাপ্তি’র স্থান-কাল-খরচ সহ আনুষঙ্গিক অনেক বিষয়েই পরামর্শ দিয়ে থাকেন। দরিদ্র এই নারীকূল, যারা শিশুকাল থেকে পারিবারিক ও সামাজিক বঞ্চনার শিকার, সামাজিকভাবে তুলনামূলক বিচ্ছিন্ন (Social Exclusion), শিক্ষার আলো যাকে কোনোভাবেই প্রভাবিত করতে পারে নাই, তাঁদের জন্য এই নিবেদিত পরামর্শ অনেকক্ষেত্রেই ‘জীবন রক্ষাকারী’ (Life Saving) হিসাবে পরিগণিত হয়। এখানে গ্রুপের অন্যান্য অভিজ্ঞ ও পুরাতন সদস্যাদের ভূমিকাও অনস্বীকার্য – তাঁরা তাঁদের বয়সজনিত অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারিক জ্ঞান সাপ্তাহিক গ্রুপ মিটিংগুলিতে আলোচনা করে থাকেন, যার সুফল পান বয়সে নবীন ও অনভিজ্ঞ সদস্যরা।  বাইপ্রোডাক্ট: আমরা সবাই জানি যে, ক্রুডওয়েল রিফাইন করে পাওয়া যায় পেট্রল, ডিজেল, কেরোসিন ও জেটফুয়েল যা জ্বালানী হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু, এটা কতজন জানেন যে, দুনিয়ার প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রি’র কাঁচামালও কিন্তু পেট্রোলিয়াম শিল্প থেকেই আসে। প্লাষ্টিক ছাড়াও রাবার, টায়ার, সিনথ্যাটিক ফাইবার ইত্যাদির উৎস কিন্তু ক্রুডওয়েল বা পেট্রোলিয়াম ইন্ডাস্ট্রি। আমরা আজ ক্ষুদ্রঋণের ‘বাইপ্রোডাক্ট’র গল্প করবো, যেখানে ঋন সুবিধা ছাড়াও এমনকতগুলি বাইপ্রোডাক্ট ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রতিনিয়ত উৎপাদিত হচ্ছে যা আমাদের মতো জনবহুল দরিদ্র দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করে আসছে।    আসিয়া আক্তারের গল্প: শিবগঞ্চের প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে আসিয়া আক্তার। দিনমজুর বাবার পাঁচ (৫) সন্তানের মধ্যে আসিয়া আক্তারের সিরিয়াল হলো চার (৪)। একমাত্র ভাই আসগর আলীর সিরিয়াল হলো পাঁচ (৫)। বুঝতেই পারছেন কি ‘কদরে’ (!) আসিয়া আক্তার বাবা-মা’র সংসারে বড় হয়েছেন! কোনরকমে ‘বড়’ হয়েছে আসিয়া – ঋতুচক্রের আগমনে আসিয়া’কে স্বামী’র বাড়িতে স্থানান্তরে একরকম হন্যে হয়েই বাবা-মা দিনাতিপাত করেছেন। তাই, দরিদ্য রিকশাওয়ালা মজনু মিয়া’র ঘরে এসে পেটের টানাপোড়ন না মিটলেও মানসিক দৈন্যতার হাহাকার যেনো আনুপাতিক হারে অনেকটাই কমে গিয়েছিলো। বিয়ের বছর যেতে না যেতেই আসিয়া হয়ে পড়েন ‘প্রেগনেন্ট’ – কিশোরী আসিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই সংসার জিবনের জটিল ও কঠিন জোয়াল নিতে একরকম বাধ্য হন। অনাগত সন্তানের প্রত্যাশায় যুবক মজনু মিয়া আনন্দে দিনাতিপাত করতে থাকেন। স্বামীর খুশী দেখে, আসিয়াও খুশী। অপুষ্ট আসিয়া বস্তিতে থাকলেও, বস্তি’র আর দশটা পরিবারের সাথে এখনো অতটা ‘ফ্রি’ হতে পারে নাই। বিয়ের পরের প্রথম দিনগুলি’র মতো গতর খাটিয়ে কাজের অভ্যাস, প্রেগনেন্সি’র চার মাসেও চলমান রয়েছে। শরীরের ভেতর যে আরেকটি শরীর বেড়ে উঠছে, তার দিকেও যে খেয়াল করতে হবে, দু’মুঠো অন্ন যে আসিয়া’কে বেশী পেতেই হবে – কথাগুলি কে বলবে? এর ওর সাথে পরামর্শেরও তো কোনো সুযোগ আসিয়া পাচ্ছে না। আচ্ছা আসিয়া’র মা কি জানে এসব ব্যাপারগুলি – বলতে পারতো? কি জানি – আসিয়া তো বিয়ের পরে বাবা-মা’র কাছে একবারও ফেরত যায়নি। মজনু মিয়া’র সংসারে অভাব থাকলেও, মানুষ হিসাবে মজনু মিয়া ওতো খারাপ না – তাকে একরকম যত্ন-আত্তি’র মাঝেই রেখেছে, তাঁর সামর্থের মধ্যে। আসিয়া বুঝতেই পারলো না, পেটের অনাগত জীবন কখন যে ‘মিসক্যারেজ’ হয়ে গেলো!!!  সতেরো বছরের কিশোরী আসিয়া আক্তার পরবর্তীতে স্বামী’র পরামর্শে ও পেশার প্রয়োজনে নিলুফা আপার সাথে সাক্ষাৎ করে। নিলুফা স্থানীয় এক এনজিও কর্মী, সৎ-আন্তরিক-অভিজ্ঞ। আসিয়া আক্তারের প্রয়োজন ১টা ভ্যান কিনার অর্থ, যা তার স্বামী নিজেই চালাবে। আসিয়া’কে ভর্তি করে নেয়, সদস্য হিসাবে। অল্প অল্প সঞ্চয় জমা করে, একসময় ঋন পরিচালনা’র উপযুক্ত মনে করে এনজিও সংস্থাটি। ঋণ নিয়ে সংসারে কিছুটা আয় বৃদ্ধি’র আশায় স্বামী-স্ত্রী দেখতে থাকে সুখস্বপন। অবশেষে, এনজিও’র টাকায় আসিয়া ভ্যান কিনে দেন স্বামীকে। অন্যের রিকশা টানা বাদ দিয়ে, মজনু শুরু করেন নিজের ভ্যান চালানো।  ওদিকে সাপ্তাহিক কেন্দ্র মিটিং-এ আসিয়া’র সাথে পরিচয় হয় স্বপা, নার্গিস, রোকসানা সহ আরো অনেকের। গ্রুপ লিডার স্বপ্না আপা এই কেন্দ্রে সদস্য হিসাবে আছেন প্রায় আট বছর। তাঁর পরিবারের মুদির দোকান – স্বপ্না ও তাঁর স্বামী যৌথভাবে তা পরিচালনা করেন। স্বপ্না আপা শুধু যে বয়সেই সবার সিনিয়র তাই নয় – সামাজিক ও পারিবারিক অনেক বুদ্ধি-পরামর্শও উনি গ্রুপ মিটিং-এ সবার সাথে শেয়ার করেন। লোন আপা নিলুফা’র কাজে অনেক সহযোগীতা আসে স্বপ্না, নার্গিস, রোকসানা’দের বুদ্ধি-পরামর্শ। আর এই সাপ্তাহিক গ্রুপ মিটিং-এই আসিয়া জানতে পারেন তাঁর পেটের প্রথম জীবন ‘মিসক্যারিজ’ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ – অল্পবয়সে গর্ভধারন, অপুষ্টি, অতিরিক্ত মানসিক ও শারীরিক চাপ গর্ভধারণের ৪ থেকে পাঁচ মাসের মাথায় গর্ভের ভ্রুণ নষ্ট করে দিতে পারে – যা প্রকারন্তরে ‘মিসক্যারেজ’ বা গর্ভপাত নামে পরিচিত। এনজিও’র এসব সভা থেকে আসিয়া বুঝতে পারেন অল্প বয়সে মা হবার না-না জটিলতার কথা। নিকটতম পারিবারিক স্বাস্থ্যক্লিনিকসহ সরকারী বিভিন্ন কর্মসূচী সম্পর্কেও আসিয়া অনেক কিছু জানতে পারেন এই কেন্দ্রমিটিং থেকেই। বুদ্ধি-পরামর্শগুলি ভ্যানচালক স্বামী’র সাথে শেয়ার করতে ভুল করেন নি। তাঁদের যৌথ শলা-পরামর্শেই আসিয়া দম্পতি’র ঘর আলো করে আসে ছোট্য ‘ইশা খাঁ’, ভ্যান কেনার প্রায় চার বছরের মাথায়।   স্বল্প শিক্ষিত আসিয়া ও অশিক্ষিত স্বামী এবারে বুঝতে ভুল করেন না তাঁদের ভবিষ্যৎ করনীয় কি? ইশা খাঁ’কে পাড়ার স্কুলে ভর্তি’র ব্যাপারে বাবা-মা

Blog

যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না। (২য় অংশ)

ঋণসিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে করণীয় প্রশ্ন যে প্রশ্নগুলির জবাব থাকাটা আবশ্যক: ঋণসিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে করণীয় প্রশ্ন যিনি ঋন পাবার জন্য আপনার কাছে এসেছেন, তার কাছে জানতে চান ঠিক কি কারনে তার টাকার প্রয়োজন এবং কত টাকা প্রয়োজন। জিজ্ঞাসা করুন কিভাবে তিনি লোনের টাকাটা কিস্তি (installment) হিসাবে ফেরত দিবেন, কত সময়ের মধ্যে দিবেন, কত সময় অন্তর দিবেন। লোন বিতরনের পরিমান, কিস্তির সাইজ ও সংখ্যা এবং শেষকিস্তি’র তারিখ ইত্যাদি থেকে ‘অংক’ করে বের করুন যে, সম্ভাব্য ঋনী সদস্য’র আবেদিত চাহিদার সাথে মাঠের বাস্তবতা মিলছে কিনা। কাজ এখানেই শেষ নয়। সরজমিনে যাচাই করতে হবে, এবং অবশ্যই। ধরুন, আলিফা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের প্রোপাইটর আলিফা’র বাবা আপনার কাছে ১ লক্ষ টাকা লোন চাইলেন ১২মাসের জন্য। ফ্ল্যাট মেথডে শতকরা ১২.৫ টাকা সুদে ১বছরে তার ঋণের মোট সুদ হয় ১২,৫০০ টাকা। এই হিসাবে তার মাসিক কিস্তির পরিমান দাঁড়ায় ৯,৩৭৫ টাকা। আলিফা’র বাবা খুব জোর গলায় আপনাকে বললেন এই টাকা দিয়ে তিনি দোকানের জন্য চলতি সম্পদ যেমন দুধ, ডিম, তেল সহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনবেন। আপনি দোকানে গেলেন, গিয়ে দেখলেন দোকানের শেলফগুলি ‘খালি খালি’! আপাত:দৃষ্টিতে আপনার মনে হলো আলিফার বাবা’র কথায়তো যুক্তি আছে, উনি তো দোকানের জন্য নতুন পণ্যই সংগ্রহ করবেন। যে প্রশ্নের জবাব আপনার চাই, তাহলো – ১) আসলেই কি উনি নতুন পণ্যই কিনবেন? নাকি, পুরাতন ঋণ শোধ করবেন?২) দোকানের বিক্রি-বাট্টা দিয়ে উনি কিস্তি শোধ করতে পারবেন কিনা? ৩) ১ লক্ষ টাকা দিয়ে তিনি আসলে কতদিনের চলতি সম্পদ ক্রয় করতে পারবেন? ৪) এই ১লক্ষ টাকাটা আদৌ তার প্রয়োজনের জন্য যথেষ্ট নাকি তা আলিফার বাবাকে আরো বেশী করে ঋণগ্রস্থ করবে? ৫) আলিফাদের পরিবারে সদস্য সংখ্যা কত? প্রতি মাসের পারিবারিক ব্যয় বাবদ আলিফার বাবাকে কত টাকা খরচ করতে হয়? ৬) ব্যক্তিগত বা সংস্থাগত ধার আরো আছে কিনা? ৭) আয় থেকে ব্যয় বাদ দেয়ার পরে কি কিস্তি ফেরতের টাকা হচ্ছে? ইত্যাদি। জবাবের জন্য আপনার চেষ্টাটা কিরকম হবে? উপরের প্রশ্নগুলি করা সহজ হলেও এর উত্তর পাওয়া সহজ না। আবার সব প্রশ্নের উত্তর যে আপনি শতভাগ সঠিক পাবেন তাও প্রত্যাশা করবেন না। তবে, একটা ভাত টিপে যেরকম পুরো হাড়ির ভাতের অবস্থা জানা যায়, এখানেও সেই যুক্তি কিছুটা হলেও খাটাতে পারেন। তথ্যের সাথে আপনার অভিজ্ঞতা, ব্যক্তি’র কথা মূল্যায়ন করার দক্ষতা – ঋণ সিদ্ধান্ত নিতে আপনাকে অনেকটাই সাহায্য করতে পারে। সরজমিনে আলিফা স্টোরে গিয়ে দেখুন। দোকান যিনি চালাচ্ছেন তার সাথে কথা বলুন। দোকানে কে বসে আছেন – কর্মচারী একা, নাকি আলিফার বাবাও আছেন? কর্মচারী কি চটপটে আছেন? বেচা-কেনা কেমন হচ্ছে খেয়াল করুন। বিক্রি কি বাকিতে হচ্ছে না নগদে? বাকি’র খাতাই যদি মোটা হতে থাকে তাহলে সতর্ক হওন। আলিফাদের বাসায় যান। কিছু সময় তাদের ওখানে বসুন – আলাপ করুন আলিফার মা’র সাথে, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে। বাসার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। গল্পোচ্ছলে জানতে চাইতে পারেন তাদের পরিবারকে আরো কোনো কিস্তি চালাতে হয় কিনা। ঋণের পরিমান কত, কতগুলি লোন বর্তমানে চালাতে হচ্ছে আলিফার বাবাকে – অথবা, আদৌ কোন লোন আছে কিনা! আশেপাশের দু’এক পরিবারের সাথে কথা বলুন না ! তাদের কাছে আলিফাদের পরিবারের কোনো দায়-দেনা আছে কিনা খোঁজ নিন। বাসায় বউ-জামাই-য়ের ঝগড়া কেমন চলে – কি ব্যাপারগুলি নিয়ে ঝগড়া করেন স্বামী-স্ত্রী? কিছুটা স্পর্শকাতর হলেও – এগুলি কিন্তু খুবই উপকারী ক্লু হতে পারে আপনার ঋণ সিদ্ধান্তের জন্য। আপনি তো এনজিও কর্মী – আশে-পাশে’র আরো এনজিও কর্মী বা সমবায় সমিতি’র মাঠকর্মী’র সাথে আপনার সদ্ভাব থাকাটা আপনার কাজের জন্য উপকারী হতে পারে। তাদের সাথে যোগাযোগ করুন – অন্য এনজিও’তে আলিফার বাবার কোন কিস্তি চলছে কিনা খোঁজ নিতে পারেন! ব্যবসা বা পারিবারিক প্রয়োজনে একজন ব্যক্তি বা উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী একাধিক ঋণ নিতেই পারেন। আলিফার বাবাও একাধিক ঋণ নিতে পারেন। আপনাকে প্রথমে বুঝতে হবে, আলিফার বাবার কথা আর চলমান বাস্তবতা মিলছে কিনা – যদি তফাৎ পান, তবে সতর্ক হওন! দ্বিতীয় যে কারনে, অন্যান্য ঋণ প্রাপ্তির ব্যাপারে খোঁজ নেয়া দরকার তাহলো উনার ব্যবসার আয়ের সাথে ঋণের কিস্তিসহ পারিবারিক ও ব্যবসার খরচের পার্থক্যটা কি ধনাত্মক নাকি ঋণাত্মক দাঁড়াচ্ছে তা বুঝতে পারা। ঋণাত্মক হলে তো ‘বিগ নো’! আলিফার বাবা কি যথেষ্ট উদ্যোমী – হ্যাঁ। তবে আগে ছিলেন, এখন আর অতটা নন। কেমনে বুঝলেন? উনার মুখের কথায়? না। তার ‘বডি ল্যাংগুয়েজ’ কি বলে? তার চোখ ও শরীরের ভাষা বোঝার চেষ্টা করুন। আমাদের মুখের কথার থেকে আমরা শারীরিক ভাষায় ‘সত্য’কে প্রকাশ করি অনেক অনেক বেশী। যেকারনে, প্রেমিকের লক্ষ-কোটি ‘আই লাভ ইউ’ শোনার পরেও প্রেমিকার মন গলে না! আর হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার না বললেই নয়। আলিফার বাবা মানুষ হিসাবে কেমন? ঋণের ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলে উনি কি সহজভাবে নিতে পারেন নাকি কথায় কথায় ‘মেজাজ’ দেখান। মনে রাখবেন, ঋণী সদস্য’র মেজাজ বা এটিচিউড (Attitude) প্রবলেম কিন্তু পরবর্তীতে একজন লোনঅফিসারের জীবনকে অসহনীয় করে তুলতে পারে – কিস্তি যদি অনিয়মিত বা খেলাপী হয়ে পড়ে! সবশেষ কথা: সংস্থা থেকে আপনার টার্গেট আছে – আমি জানি। টার্গেট এচিভ করার পেরেশানি আপনার আছে – সেটাও জানি। কিন্তু, টার্গেট ফিলাপ করতে গিয়ে আপনি যদি ভুল ধারনা বা তথ্যের উপর ভর করে একটা বাজে ঋণ চুক্তি করে ফেলেন, তাহলে কিস্তি’র পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে আপনার শ্রমঘন্টার সিংহভাগ সময় চলে যেতে পারে। ঋণের সাইজ ছোট হলে তো তাও অল্পের উপর দিয়ে আপনি ঋণঝুঁকি বিশ্লেষণ করতে পারেন; কিন্তু, ঋণ আবেদনের পরিমান বেশি হলে অথবা, ঋণের ডিসবার্সমেন্টের পরিমান যদি বেশী করতে চান – অবশ্যই সময় দিতে হবে, মনোযোগ দিতে হবে, ঝুঁকি বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখবেন – ‘সঠিক ঋণ বিতরন, সহজে কিস্তি আদায়’। আবেদিত সদস্যর আয় যেন অবশ্যই ঋণের কিস্তিসমেত মাসিক অনুমিত মোট ব্যয়ের থেকে বেশী বৈ কম না হয়। অংকটা ঠিকমতো করতে জানলে আপনাকে আর ঠেকায় কে!… (১ম অংশ পড়ুন) লেখকঃ আ.ই মুকসিত (এক্স ব্যাংকার)

যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না।
Blog

আপনি কি ক্রেডিট অফিসার? যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না। (১ম অংশ)

যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না। ক্ষুদ্রঋণের বাস্তবতা:  যে বিষয়গুলির জবাব ছাড়া ঋণসিদ্ধান্ত নিবেন না। সুন্দর মুখের প্রেমে পড়া আর অন্যকে টাকা ধার দেয়া দু’টিই খুব সহজ কাজ। অর্থ কেন প্রয়োজন? এই প্রশ্নের জবাব আছে অগনিত। প্রয়োজন না থাকলেও ‘প্রয়োজনীয়’ বানানোর তরিকা আছে শত শত। দুনিয়াতে চলতে গেলে অর্থ বা টাকা-পয়সাই যেহেতু প্রধানতম মাধ্যম, কাজেই ‘কেন আমার অর্থ দরকার’ এই প্রশ্নের শত-হাজার জবাব রয়েছে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দুনিয়ার শতকরা ১০ ভাগ সবচেয়ে ধনী মানুষের কাছে দুনিয়ার মোট সম্পদের  ৮৫ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত রয়েছে! আরো একটি তথ্য দেই –দরিদ্রতার দিক থেকে নীচে অবস্থান করা পৃথিবীর শতকরা ৫০ ভাগ মানুষের কাছে আছে মাত্র ১ শতাংশ সম্পদ। কি অবাক হচ্ছেন? ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের তথ্য [Poverty, Prosperity and Planet Report 2024] অনুযায়ী পৃথিবীতে ৩৫০ কোটি মানুষ (৪৪ শতাংশ) দারিদ্রসীমার (যাদের দৈনিক আয় ৬.৮৫ ডলারের কম) নীচে বাস করে, যা কিনা এতো এতো প্রযুক্তিগত উন্নতি সত্বেও গত প্রায় ৩৫বছর ধরেই অপরিবর্তিত রয়েছে। ২০২২ সালের তথ্য মতে বাংলাদেশের এক পঞ্চমাংশ জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। এই দরিদ্র মানুষগুলি’র পক্ষে তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাইরের অন্যকোন ‘প্রয়োজন’ মিটানোটা দারুন কষ্টসাধ্য। এই বিপুল জনগোষ্ঠী কোন না কোনভাবে অর্থের সন্ধানে তাদের জীবনের সিংহভাগ সময় ব্যয় করে চলেছেন। আমরা যখন ফেসবুক বা অন্যকোন সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাদের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনার সফটওয়্যার স্বস্তি’র mfi247 অথবা coopBank247-এর প্রোমোশন করি, তখন সিংহভাগ রেসপন্ড পাই তাদের কাছ থেকে যারা কোন না কোন কারনে ক্ষুদ্রঋণ নিতে আগ্রহী, সফটওয়্যার সেবা নয়। এদের অনেকে গৃহস্থ, ছাত্র, ক্ষুদ্রব্যবসায়ী, গৃহিনী। তাদের প্রয়োজনটা যেমন অমূলক নয়, তেমনি তাদের প্রয়োজনটা দেশের অলিগলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঋণ কর্মসূচীতে নিয়োজিত এনজিও বা সমিতিরাও সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে মিটাতে পারছেন না। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ও ক্রেডিট অফিসার: এদেশে বর্তমানে সাতশ’র উপরে এমএফআই (MFI) ও কয়েক হাজার সমবায় সমিতি বা কোঅপারেটিভ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে নিয়োজিত। এই প্রতিষ্ঠানগুলির মূল কাজ হলো ঋণ দেয়া ও তা আদায় করা। সাথে থাকে সঞ্চয় জমা ও উত্তোলন। নিরলসভাবে যিনি এই কাজটি করেন তিনি হলেন মাঠকর্মী (Field Officer) বা ক্রেডিট অফিসার (Credit officer)। তাঁদের কাজ পরিশ্রমসাপেক্ষ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সময়সাপেক্ষও বটে। বাংলাদেশে ঋণ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত নাজুক – এখানে আইন আছে, কিন্তু ঋণ খেলাপী বা তামাদি হলে তার প্রয়োগটা সময়সাপেক্ষ ও কষ্টসাধ্য – অনেকক্ষেত্রেই বাস্তবতার সাপেক্ষে বাস্তবায়ন অযোগ্য। আমরা বড়দের দিকে তাকিয়ে আমাদের নিজেদের চলার পথ তৈরী করার প্রয়াস পাই। এনজিও বা সমবায়ী প্রতিষ্ঠানগুলির জন্য পথিকৃত যদি হয় দেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, তাদের পোর্টফোলিও’র ঋণ খেলাপী সংস্কৃতি আমাদের জন্য খুব একটা আশার বানী শোনাবে না। ২০২৫-এর তথ্য অনুযায়ী দেশের ব্যাংকিং খাতে বিতরন করা ঋণের ২৫ শতাংশই এনপিএল [NPL, Non Performing Loan]। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলির এই ঋণ ফেরত পাবার সম্ভাবনা আমাদের দেশের ঋণ কালচারের বাস্তবতায় ‘সাগর সেঁচে মুক্তো পাবা’র মতোই স্বপ্নসাধ্য ব্যাপার! আপাতদৃষ্টিতে ভাল মানুষটা ঋণ পাবার পরে দেখা যায় ব্যবসায় মন্দা বা অন্য কোন কারনে এনজিও’র ঋণ আর ফেরত দেন না বা দিতে পারেন না – ঋণদাতার সাথে সম্পর্ক হয়ে যায় সাপে-নেওলে। যিনি এই সম্পর্কের সেতুবন্ধন করেন, তিনি একজন লোনঅফিসার বা ক্রেডিটঅফিসার অথবা বলা যায় মাঠকর্মী। এই লেখার কেন্দ্রিয় চরিত্র হলেন একজন মাঠকর্মী, যিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করেন সমাজের নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র ও অতিদরিদ্র মানুষদেরকে নিয়ে। রোদ-ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তাঁকে ছুটতে হয় সমিতি থেকে সমিতিতে কিস্তি আদায় এবং বাসা-বাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বকেয়া আদায়ে। তারপরে অফিস টাইমের পরে সময়টা যায় দৈনন্দিন হিসাব মিলাতে, কখনো কখনো রাত জেগে। তার প্রাইভেট লাইফ অনেকটাই বিশৃঙ্খলার জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে – মন্দ ঋণ বা কুঋণের যন্ত্রণায়। কাজেই, মাঠকর্মী’র কাজ অত্যন্ত চ্যালেন্জিং। ঋণ ও ঋণী নির্বার্চনের ত্রুটি তাঁর পেশাগত জীবনকে করে তুলতে পারে দারুনভাবে অনাকাঙ্খিত। তাই, হাজারো ব্যস্ততার ভীড়ে একজন ঋণকর্মী বা মাঠকর্মীকে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় নিয়ে সঠিকভাবে ঋণ ও ঋণী নির্বাচন করতে হবে। মুখের কথায় চিড়ে ভিজতে দিবেন না: একজন এনজিও বা সমবায় সমিতির মাঠকর্মী কাজ করেন প্রত্যন্ত গ্রামে, শহরের অলি-গলিতে। তাঁর এলাকার সবাই তাঁকে ‘লোনআপা’ বা এনজিও কর্মী হিসাবে চিনেন। যে আজ তাঁকে চিনেন না, টাকার দরকার পড়লে তিনিও আগামীকাল তাঁকে চিনে নেন। আর এটাই হোলো বাস্তবতা। মাঠকর্মী’র থাকে টার্গেট বিতরনের (Loan Disbursement) চ্যালেন্জ – উনি নিজের উদ্যোগে খুঁজেন সম্ভাব্য ভাল সদস্য। টার্গেট বাজেটের চাপে অনেকসময়ই সঠিক মানুষটিকে বেছে নেয়াটা দুষ্কর হয়ে যায় তাঁর জন্য। অবশ্যই মনে রাখতে হবে, একজন নিডি (needy) মানুষ তাঁর প্রয়োজন মিটাতে অনেকগুলি কথা বলতে পারেন – যার অধিকাংশই হতে পারে প্রয়োজনের তাগিদে বাস্তবতাবর্জিত। আমাদের বর্তমান সমাজের বাস্তবতায়, অনেকক্ষেত্রে আমরা সত্যটা গোপন রেখে হলেও আমাদের প্রয়োজনটাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকি – যেকারনে শুধু মুখের কথাগুলি সর্বদা বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে।…. (২য় অংশ পড়ুন) লেখকঃ আ.ই মুকসিত (এক্স ব্যাংকার)

ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?
Blog

ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?

ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান? প্রচলিত আছে ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম কার্যকরভাবে শুরু হয় আমাদের এই বাংলাদেশে। আঠারো কোটি জনসংখ্যার দরিদ্র এই দেশে ১মবারে মতো সমিতিভিত্তিক সফল ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালু হয় ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্পের মাধ্যমে । আর এই ক্ষুদ্রঋণের কনসেপ্ট যে মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে সমর্থ হতে পারে তা ড: মু: ইউনুস ও তাঁর সৃষ্ট প্রতিষ্ঠান গ্রামীন ব্যাংকের নোবেল প্রাপ্তি’র মাধ্যমে বিশ্ববাসী জানতে পারেন। গল্প দিয়ে শুরু করা যাক… দুইটা উদাহরণ লক্ষ্য করি। আমি যে এলাকায় থাকি, ওখানে একটা শেডওয়ালা কাঁচাবাজার আছে। কাঁচাবাজারের একপাশে তরিতরকারী’র দোকান থাকলেও অন্য আরেকপাশের বেশকিছু দোকানে ডিম ও কলাসহ বিভিন্ন মৌসুমী দেশী ফল বিক্রি করে। ডিমগুলি বেশ বড় বড়, – ছোটবেলার হাঁসের ডিমগুলিই শুধু বড় ছিলো, তুলনামূলকভাবে। আর এরকম দোকানের সংখ্যা ওই মার্কেটে প্রায় সাত-আটটি। বড় আর পরিষ্কার একডজন মুরগীর ডিম কেনার সময় কোন এক সন্ধ্যায় দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলাম বাজারের সমান একই দাম রেখে এরকম বড় ডিম বিক্রি করলে তার কোন লাভ হয় কিনা? পান-খাওয়া মুখে একগাল হেসে ঝরনা খাতুন বললেন, আমাদের তো বিক্রি বেশী! বুঝলাম, ওনার ব্যবসায় আনন্দ আছে, দু:খ কম। এরপরে কথায় কথায় জানতে পারলাম, তাঁর ডিমের চালানের অর্থলগ্নী হয়েছে কোন একটা সমবায় সমিতি’র ক্ষুদ্রঋণের কল্যানে। উনি খুশি। স্বামী রিকশা চালালেও উনি গর্বের সাথে জানালেন, কামাইটা তার’ই বেশী। দুই ছেলে-মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছেন এবং বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ উনিই বহন করে যাচ্ছেন। কিস্তি দিয়ে যাচ্ছেন নিয়মিত। (ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?) আরেকটা সত্য গল্প বলি। আমাদের পাড়ার রাস্তার মোড়ে দু’টো দোকান দেখছি অনেক বছর থেকেই। দুটো’ই মুদি দোকান। আয়তনে প্রায় সমান দু’টো দোকান পাশাপাশি। টাক মাথার ফর্সা চেহারার রুস্তমের দোকানে দোকানী একাই এবং সে হোলো রুস্তম। এবং পাশের দোকানের মালিকানা সেই করোনার আগে থেকেই দেখে আসছি পরিবর্তন হয়ে আসছে, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই। যদিও এই দোকানের পজিশন, রুস্তমের দোকানের থেকে বেটার, কারন কর্ণারপ্লট। ৪টা গলির এই কর্ণারের দোকানের স্বাভাবিক আকর্ষন থাকা সত্ত্বেও ফিবছর এর মালিকানা পরিবর্তন হচ্ছে। (ক্ষুদ্রঋণ: সমস্যা না সমাধান?) রুস্তম দেখতে আকর্ষণীয় হলেও, তার ব্যবহার তুলনামূলকভাবে গম্ভীর, কাজেই অন্যান্য খরিদ্দারদের মতোই ঘরের কাছের মুদি সদাই হিসাবে ‘মা জেনারেল স্টোর’ নামের কর্নারের এই দোকানটা আমারও পছন্দের। একদিন, দোকানী কামালের সাথে আলাপ জুড়লাম। কথা থেকে যেটা বের হলো, কামাল একজন কর্মচারী বৈ, কিছু না। বর্তমান মালিকও দোকানের পজিশন ছেড়ে দেয়ার চিন্তায় আছে – ভাল কোন খরিদ্দার পেলে সে তা ছেড়ে দিবে। কেন? কেন? কারন হিসাবে সমিতি’র কিস্তি, দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, কর্মচারী’র বেতন আর বাকি’র খরচ সবকিছু যোগ করার পরে নাকি মাস শেষে মালিকের উল্টো আরো কিছু টাকা না পুরলে পরের মাসের সদাই কেনার ‘মূলধন’ যোগাড় হয় না। এহেন ‘উল্টো ম্যাথে’র যন্ত্রনায় মালিক দোকানের পজিশন ছেড়ে দেয়ার জন্য উতলা হয়ে আছেন। বলাই বাহুল্য, ‘মা জেনারেল স্টোর’-এর এই গল্পটা সম্ভবত: ফিবছর একই থাকে। অন্যদিকে রুস্তমকে আমি এই পাড়ায় আসার পর থেকে কখনও দোকান ছাড়া বাইরে কোথাও দেখিনি, শুধুমাত্র শুক্কুরবার জুম্মা’র নামাজের সময় মসজিদের সামনের রাস্তায় পাটি বিছিয়ে নামাজের জন্য দাঁড়ানো ছাড়া! তার কি এনজিও’র লোন নাই, জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য একবার ওকে বলতে শুনেছি, ‘আমার নিজের হাতে কাজ করতে ভালো লাগে’! উপরের দু’টো গল্পই আমাদের আশেপাশের প্রাত্যহিক জীবন থেকে নেয়া, যেখানে দু’টো দোকানীই তাদের ব্যবসার তারল্য সম্পদ বৃদ্ধি’র জন্য ক্ষুদ্রঋণের দারস্থ হয়েছেন – একজন হাসিমুখে (অব্যক্ত) কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, অপরজন সুফলটা পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। দায়ী কে? ঘটনা দু’টো থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এনজিও বা সমবায় সমিতিগুলো আমাদের প্রাত্যহিক ও ব্যবসায়িক প্রয়োজনে জামানতবিহীন  ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করে আমাদের সংকটকালীন তারল্য মোকাবিলায় সহযোগীতা করেন। কিন্তু, আমরা যদি তা সঠিক পদ্ধতিতে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হই, তা আমাদেরকে শুধু ঋণগ্রস্থই করে না আমাদের জীবনের সুখও কেড়ে নিতে পারে! তাহলে উপায়? বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনাকারী এনজিও’র সংখ্যা ৭০০+ এবং আরও প্রায় ৩০০-র অধিক প্রতিষ্ঠান এমআরএ (MRA) থেকে অস্থায়ী সনদের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। এছাড়াও হাজারো সমবায়ী প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আনাচে-কানাচে তাদের সদস্যদের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বিভিন্ন অনলাইন সার্চ ব্যবহার করে এটা খুব নির্ভরযোগ্যভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশের প্রতি ৪জনের মধ্যে ১জন ব্যক্তি কোন না কোন ভাবে ক্ষুদ্রঋণ নির্ভর (এনজিও-এমএফআই, একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প, সরকারী ও বেসরকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি), যাদের ৯০ শতাংশই নিয়মিত এই ঋণ পরিশোধ করে আসছেন। যদি এই সংখ্যাগুলি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে একথা অস্বীকার করার কি কোন উপায় আছে যে, ক্ষুদ্রঋণের সঠিক ব্যবহারে মানুষ দারিদ্য থেকে মুক্তি পেতে পারেন, নিজের জীবনমান উন্নত করতে পারেন?   আমাদেরকে জানতে হবে ঋণ-প্রাপ্তির পূর্বের সঠিক অংক কষতে এবং নির্ধারণ করতে হবে ঋণের সঠিক ব্যবহার ও ফেরতের পূর্ণাংগ কর্মপন্থা। তাহলেই আমরা পেতে পারি ঝরনা খাতুনের তৃপ্তিমাখা হাসি’র আড়ালে একজন স্বাবলম্বী ও আত্মপ্রত্যয়ী উদ্যোক্তা’র গল্প, ঘরে ঘরে। পুন:শ্চ: ‘মা জেনারেল স্টোর’ আর নাই – নতুন দোকানের নাম ‘ওয়াশকুরুনী অটো ড্রাই ক্লিনার্স’। নতুন মালিককে এখন দোকানের শেলফ ভরাট করতে কিস্তি গুণতে হয়না, বাকিতে পণ্য বিক্রির প্যারাও নাই। দেখা যাক কি হয়…. লেখকঃ আ.ই মুকসিত (চেয়ারম্যান, বিডি জবস) পরবর্তী

en_US
Scroll to Top